লালমাই (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
কুমিল্লার লালমাই উপজেলার সমেষপুরে নাইমুল ইসলাম (১৯) নামের এক যুবককে চুরি ও মাদক সেবনের অভিযোগে শিকলবন্দি করেছেন তার বাবা সাইফুল ইসলাম লিটন। ছেলের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে সোমবার (৯ অক্টোবর) দুপুরে স্থানীয়দের সহায়তায় তিনি ফয়েজগঞ্জ বাজারস্থ একটি ওয়ার্কসপে নিয়ে তাকে দুই হাত ও দুই পায়ে স্থায়ীভাবে শিকল পরিয়ে দেন। এরপর হাতের শিকল গলায় ঝুলিয়ে তালা লাগিয়ে দেন।
সোমবার দুপুর ২টায় উপজেলার ফয়েজগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, শিকলবন্দি নাইমুল ইসলাম এক ইঞ্চি দুই ইঞ্চি করে বাড়ির পথে আস্তে আস্তে হাঁটছেন।
গায়ে সাদা ও লাল রংয়ের একটি জার্সি, পরনে গোলাপী রংয়ের থ্রি কোয়াটার টাউজার। তার দুই হাত ও দুই পায়ে স্থায়ীভাবে শিকল। হাতের শিকল গলায় ঝুলিয়ে তালা লাগানো। কিছুক্ষণ হাটার পরই তার বাবা সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে এসে তাকে বাড়ি নিয়ে যান।
নাইমুলের বাবা সাইফুল ইসলাম লিটন বলেন, আমি পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছি। পেশায় আমি একজন সিএনজি অটোরিকশা চালক। পরিবারে আমার স্ত্রী ও ৫ সন্তান রয়েছে। নাইমুল ইসলাম আমার বড় ছেলে।
গত ৫/৬ বছর আগে থেকে সে মাদক সেবন শুরু করে। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও আমি তাকে সংশোধন করতে পারিনি। প্রায় এক বছর তাকে আমি টাকা খরচ করে মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে রেখেছি। সেখান থেকে বের হয়ে মাদক সেবনের টাকা জোগাতে চুরি শুরু করে। প্রথমে আমার নিজের ঘরের টাকা ও মোবাইল চুরি করতো।
একপর্যায়ে সে আমার গ্রামের মসজিদের রড চুরি করে বিক্রি করে দেয়। অবশ্য সেই রড আমি উদ্ধার করে আবার মসজিদে ফেরত দেই। তিন দিন আগে আমার ঘরের ফ্রিজ ভেঙে ফেলে। আমার স্ত্রীর ওপর হামলা করে। আমি ৯৯৯ নম্বরে কল করে পুলিশি সহায়তা চাই। সেখান থেকে আমাকে লালমাই থানার ওসির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। তখন ওসি বলেছিলেন পুলিশ ফোর্স আসতেছে। অপেক্ষা করেন। এখন পর্যন্ত পুলিশ আসেনি, খবরও নেয়নি। আমি ও আমার পরিবার মাদকাসক্ত ছেলের কাছে জিম্মি হয়ে আছি। যেকোনো সময় সে আবার আমার স্ত্রী ও অন্য সন্তানদের ওপর হামলা করতে পারে। আমি বাধ্য হয়ে ছেলেকে শিকলবন্দি করেছি।
শিকলবন্দি নাইমুল ইসলাম বলেন, লাকসামের কাজল আমাকে ৩০০ টাকা করে ইয়াবা দেয়। আমি ইয়াবার টাকার জন্য চুরি করতাম। ঘরে ভাঙচুর করতাম। আজকে আমাকে আমার বাবা শিকল পরাতে ফয়েজগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসছে। খোকন, সাহাবুদ্দিন, আরিফ ও মামুন আংকেলরা আমাকে শিকল পরিয়েছে। শিকলের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছি। হাত-পায়ের চামড়া উঠে যাচ্ছে। আগের মতো হাঁটতে পারছি না। আমি ভালো হতে চাই। আমাকে শেষবারের মতো সুযোগ দেওয়া হোক।
শিকলবন্দিতে সহায়তাকারী ফয়েজগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী মামুন বলেন, নাইমুলের বাবা একজন আওয়ামী লীগের নেতা। ছেলের কর্মকাণ্ডে ওনার মানসম্মান সব শেষ। তিনি অতিষ্ঠ হয়ে ছেলেকে শিকল পরাতে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন। আমরা নিজে থেকে শিকল পরাইনি।
পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার সাইফুল্লাহ বলেন, শিকলবন্দির বিষয়টি আমি জানি না। তবে ছেলেটি নষ্ট হয়ে গেছে। মাদকাসক্ত হওয়ায় আমিও কয়েকবার ডেকে এনে সংশোধন করার চেষ্টা করেছি।
কুমিল্লা জজকোর্টের আইনজীবী মো. মিজানুর রহমান অন্তর বলেন, অবাধ্য হয়ে কোনো সন্তান যদি মা-বাবার ওপর হামলা করে বা ভাঙচুর করে সেক্ষেত্রে মা-বাবার আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। শিকলবন্দি করা নির্যাতন ও অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন।
লালমাই থানার অফিসার ইনচার্জ মো. হানিফ সরকার বলেন, শিকলবন্দির বিষয়টি আমার জানা নেই। ৯৯৯ নম্বরে কল করলে আমি জানতাম, সেটাও অবগত নই। তবে আজ দুপুরে পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এ জি এম শফিকুর রহমান আমাকে ও ইউএনও মহোদয়কে জানিয়েছেন, ওই ছেলে নাকি তার মা-বাবার ওপর হামলা করে। তখন ইউএনও মহোদয় বলেছেন লিখিতভাবে জানালে মোবাইল কোর্ট করে সাজা দিতে পারবে।
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর ২০২৩, বেলা ০১:০৬
Discussion about this post