চাঁদপুর প্রতিনিধি
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার রামপুর গ্রামের ছবির মিয়া। পেশায় রিক্শা ভ্যানচালক। ১০ বছর আগে ধারদেনা করে বড় সন্তান মো. টিপুকে মালদ্বীপে পাঠান। প্রবাসে তার আয়ে পরিবারে মোটামুটি সুখ ছিল।
সেখানে ৪ বছরেরও বেশি সময় ছিলেন মো. টিপু। তারপর দেশে ফিরে আসেন। বাবা ছেলেকে নিয়ে নতুন পেশায় যুক্ত হন। গ্রামে নলকূল স্থাপনের কাজ।
তবে তাদের এমন সুখ বেশি দিন টেকেনি। এরই মধ্যে একদিন মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন মো. টিপু (২৮)। তবে কিছুদিন পরিবারের সঙ্গে থাকার পর একদিন নিরুদ্দেশ তিনি। তারপর কেটেছে দীর্ঘ ৬ বছর।
এতদিনে হয়তো ছেলে বেঁচে নেই। তাই সন্তানের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন বাবা ছবির মিয়া আর মা নাসিমা বেগম। কিন্তু না, একজন পুলিশ কনস্টেবলের মানবিকতায় বাবা-মা ফিরে পেলেন হারিয়ে যাওয়া তাদের আদরের সন্তান। মঙ্গলবার দুপুরে চাঁদপুর জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এমন চিত্র ফুটে উঠে।
চাঁদপুর আদালতপাড়ায় ভবঘুরে এক যুবক।
একাকি আপন মনে বসে থাকে। চুল দাঁড়িতে একাকার। শরীরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পোকামাকড়ে বাসা বাধা নোংরা পোশাক। এমন দৃশ্য কারো চোখে পড়ে। আবার কারো চোখে পড়ে না। তবে একদিন মলিন পোশাকের সেই যুবকের কাছে ছুটে যান পুলিশ কনস্টেবল আবুল হোসেন মানিক। তিনি চাঁদপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিমের দেহরক্ষী। তাই প্রতিদিনই আদালতের আশপাশে তার চোখ পড়ে। তবে অচেনা একজনকে দেখে চোখ ঘুরে যায় তার। ওই যুবকের নাম-পরিচয় জানতে চান। তাতে মিলছে না সাড়া। কিন্তু দমে যাননি পুলিশ কনস্টেবল মানিক। আদালতের ফুটপাত থেকে তুলে নেন মানসিক ভারসাম্যহীন ওই যুবককে। চুল দাঁড়ি কেটে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে শুরু করেন। এরই মধ্যে কেটে যায় এক মাস। অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেন ওই যুবক। গত ৩ আগস্ট এই যুবককে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেন মানিক। তারপর পাল্টে যায় পুরো চিত্র। বাবা-মায়ের সঙ্গে ছুটে আসা ছোটবোনকে বুকে জড়িয়ে ধরেন মো. টিপু। চাঁদপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে তৈরি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ।
পুলিশ কনস্টেবল মানিক জানালেন, শুধু এমন একজন টিপু নয়। চাকরির সুবাদে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর এবং এই চাঁদপুর মিলিয়ে এই পর্যন্ত এমন ২২ জনকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। আরো জানালেন, সমাজে অবহেলিত ভবঘুরে এমন মানুষের জন্য কাজ করছেন তিনি। এদিকে, বুকের ধন হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে ফিরে পেয়ে দারুণ খুশি বাবা ছবির মিয়া এবং মা নাসিমা বেগম। তারা জানালেন, কয়েক বছর আগে বাড়িতে সংবাদ আসে কিশোরগঞ্জে ট্রেনে কাটা পড়ে আমাদের ছেলে মারা গেছে। তারপর আর ভাবিনি সেই ছেলে আবারো বুকে ফিরে আসবে। ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশ কনস্টেবল মানিককে ধন্যবাদ জানান তারা। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড় মো. টিপু। মানসিক ভারসাম্য হারানোর আগে সাড়ে ৪ বছরেরও বেশি মালদ্বীপে ছিলেন মো. টিপু। বর্তমানে তাদের এমন কোনো আর্থিক সঙ্গতি নেই যে, ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য চিকিৎসা করাবেন।
অন্যদিকে, পুলিশ শুধু নিজ পেশায় ব্যস্ত থাকে না। সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে মানবিক দায়িত্বও পালন করে। যে কারণে কনস্টেবল মানিককে পুলিশের পক্ষ থেকে এমন মানবিকতার জন্য স্বীকৃতি দেওয়ার কথা জানান জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা এবং মো. টিপুর চিকিৎসার দায়িত্ব নেন তিনি। মঙ্গলবার দুপুরে তার কার্যালয়ে এক আনন্দঘন ও আবেগময় পরিবেশে মো. টিপুকে বাবা ও মায়ের হাতে তুলে দেন পুলিশ সুপার। এসময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) সুদীপ্ত রায়, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অভিযান ও অপরাধ) রাশিদুল ইসলাম চৌধুরী, সহকারী পুলিশ সুপার মনীষ দাশ, কোর্ট পরিদর্শক শহীদুল ইসলাম, ডি আই ওয়ান মনিরুল ইসলাম প্রমুখ।
প্রকাশ: বুধবার, ০৯ আগস্ট ২০২৩, সকাল ১০:১৭
Discussion about this post