কুবি প্রতিনিধি
পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের জের ধরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ইকবাল মনোয়ারকে সাময়িক বহিষ্কার করার ঘটনায় তোপের মুখে উপাচার্য অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈন। এই বহিষ্কারের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগেও শিক্ষার্থী বহিষ্কারে এমন অনিয়ম হয়েছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, যায়যায়দিন পত্রিকায় উপাচার্যের বক্তব্য ‘বিকৃত করে’ প্রচার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। অন্যদিকে, পত্রিকাটির বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সাময়িক বহিষ্কার হওয়া শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ার বলেন, উপাচার্য যা বলেছেন, সেটুকুই তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।
গত ৩০ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে উপাচার্যের দেওয়া বক্তব্য নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট করেছিলেন ইকবাল মনোয়ার। ‘দুর্নীতি হচ্ছে, তাই বাংলাদেশে উন্নয়ন হচ্ছে: কুবি উপাচার্য’ শিরোনামে পরদিন প্রকাশিত এ রিপোর্টের জের ধরে গত বুধবার ইকবাল মনোয়ারকে সাময়িক বহিষ্কার করে চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এদিকে ইকবালকে সাময়িক বহিষ্কার করার প্রতিবাদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকসহ শিক্ষার্থীরা গতকাল বিক্ষোভ করেছেন।
ইকবাল বলেন, উপাচার্যের বক্তব্যের অডিও রেকর্ড তাঁর কাছে আছে। উপাচার্য বলেছেন, ‘অনেকেই বলে– দেশে দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন হচ্ছে না। কিন্তু আমি বলব উল্টো কথা। দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বলেই উন্নতি হচ্ছে। এটা নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন কথা বলতে পারে।’ ইকবাল আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে তাঁকে বহিষ্কার করেছে।
আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। বহিষ্কারাদেশ দ্রুত প্রত্যাহার না করলে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন।
জানা যায়, সংবাদ প্রকাশের পর প্রক্টরিয়াল বডি ওই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। পরে উপাচার্যের নেতৃত্বে সব প্রভোস্ট, ডিনসহ পদস্থ সবাইকে নিয়ে এক সভায় ওই সুপারিশ অনুমোদন করা হয়। এর পর বহিষ্কারের চিঠি দেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার। তবে কুবির সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রক্টরিয়াল বডি সুপারিশ করলেই কাউকে সরাসরি বহিষ্কার করা যায় না। নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির সভায় তা উপস্থাপন ও অনুমোদন হওয়ার পর সিন্ডিকেটে তা তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে এসবের কিছুই করা হয়নি।
ওই অনুষ্ঠানে দেওয়া উপাচার্য আবদুল মঈনের বক্তব্যের অডিও এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তাতে ইকবালের প্রতিবেদনে উপাচার্যের বক্তব্য বিকৃত করার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানার জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার অনেকবার কল করা হলেও উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মোবাইল ফোনে কল বারবার কেটে দেওয়া হয়। তবে উপাচার্য কয়েকটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি দুর্নীতিকে উৎসাহিত বা একে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেননি, বরং শিক্ষার্থীদের ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিংয়ে উৎসাহিত করার জন্য উদাহরণস্বরূপ কিছু কথা বলেছেন। কনটেক্সট বাদ দিয়ে উদাহরণ নিয়ে একাডেমিকের ভাষায় বলা কথা এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে, যাতে মনে হচ্ছে, দুর্নীতির পক্ষে বলেছি। প্রতিবাদলিপি দিয়েছি, তাও ছাপেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে বলেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনা বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক ট্রেজারার ড. শওকত জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীকে যদি কোনো গুরুতর অপরাধেও শাস্তি দিতে হয়, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। ঘটনার জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে জবাব চাইতে হবে। কিন্তু নিয়ম না মেনেই সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। উপাচার্যের বক্তব্য বিকৃত করার অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমুর্তি ক্ষুণ্নের যে কথা বলা হয়েছে, সেটিও ঠিক না। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় একা চালান না। বক্তব্য বিকৃত হয়ে থাকলে তিনি গণমাধ্যমের রীতি এবং রাষ্ট্রীয় নীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা অথবা মানহানির মামলা করতে পারতেন। ব্যক্তিগত ঘটনায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে টেনে আনা ঠিক হয়নি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, উপাচার্য যদি এই বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটি প্রকাশ করার অধিকার সাংবাদিকের রয়েছে। বরং এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনিই অশিক্ষকসুলভ কাজ করেছেন। তাঁরই তো চাকরি যাওয়া উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়– উপাচার্যের এ বক্তব্যের মাধ্যমে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। একজন শিক্ষক দুর্নীতিকে সমর্থন করে বক্তব্য দেন এবং সেটি প্রকাশ করে সাংবাদিক বিপদগ্রস্ত হন। এতেই বোঝা যায়, শিক্ষাব্যবস্থা কোন পর্যায়ে গেছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংবাদ ভুল হলে সে জন্য প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তা না করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হলো গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করেন, তাদের মধ্যে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হবে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চার একটি বড় ক্ষেত্র।
কুবির একাধিক সূত্র জানায়, উপাচার্য হিসেবে যোগদানের দেড় বছরের মধ্যেই নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন অধ্যাপক আবদুল মঈন। ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন তিনি। ২২ মার্চ সমন্বয়হীনতা ও উপাচার্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে অস্বস্তি বোধ করছেন জানিয়ে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের পদত্যাগ করেন। ২৪ আগস্ট ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. আমিরুল হক চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেন তিনি। এতে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করা হয়। রেজিস্ট্রারের পদত্যাগের দিনই আইন ভঙ্গ করে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দেন সহকারী অধ্যাপক কাজী ওমর সিদ্দিকীকে। আইনে ওই পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ন্যূনতম সহযোগী অধ্যাপকের কথা বলা আছে। গত ২০ এপ্রিল ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেলের (আইকিউএসি) পরিচালক পদে নিয়োগ দেন অধ্যাপক রশিদুল ইসলাম শেখকে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অর্গানোগ্রামে বলা হয়েছে, এ পদে আইকিউএসির অতিরিক্ত পরিচালক অথবা আইকিউএসিতে কর্তব্যরত অধ্যাপক পদমর্যাদার কাউকে নিয়োগ দিতে হবে। তবে রশিদুল ইসলাম এর আগে কখনও আইকিউএসির কোনো দায়িত্ব পালন করেননি।
জানা গেছে, শুরু থেকেই শিক্ষকদের নির্দিষ্ট একটি পক্ষকে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন উপাচার্য। দেড় বছরের মধ্যেই অন্তত ২৫টি প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দিয়েছেন শিক্ষকদের একটি পক্ষ থেকে। একাডেমিক কাউন্সিল কিংবা সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত ছাড়াই একের পর এক শিক্ষার্থী বহিষ্কার করেছেন তিনি। গত ৭ মার্চ বহিষ্কার করেন লোকপ্রশাসন বিভাগের এনায়েত উল্লাহ ও ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সালমান চৌধুরীকে।
প্রকাশ: শুক্রবার, ০৪ আগস্ট ২০২৩, সকাল ১১:০৪
Discussion about this post