নিজস্ব প্রতিবেদক
নতুন শিশুর আগমনকে ঘিরে পরিবারে ছিল আনন্দের বন্যা। কিন্তু সেই আনন্দ এখন রূপ নিয়েছে বিষাদে। রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের অবহেলায় মারা যায় নবজাতক। আইসিইউতে ছিলেন মা মাহবুবা রহমান আঁখি। ৭ দিনের মাথায় গত রোববার দুপুরে ল্যাবএইড হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। নতুন বাবা-মা হওয়ার খুশিতে ভাসছিলেন এই দম্পতি। ছিল সব ধরনের প্রস্তুতি। স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে এখন পাগল প্রায় ইয়াকুব আলী। তার ৪ বছরের সাজানো সংসারে নেমে এসেছে ঝড়।
আঁখির জন্মের ৯ মাস পরে মারা যান তার বাবা। তিনি পুলিশে কর্মরত ছিলেন।
এরপর মায়ের কাছে কুমিল্লার লাকসামে দাদার বাড়িতে তিনি বেড়ে ওঠেন। সেখানে চাচাদের যত্ন এবং ভালোবাসার ছিল না কোনো কমতি। আঁখি পড়তেন ইডেন কলেজে। বুঝতে দিতেন না বাবা না থাকার কষ্ট। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে আঁখির মা নুরজাহান আক্তার ভুলে থাকতেন স্বামী হারানোর কষ্ট।
সন্তানকে নিয়ে দেখতেন নানা স্বপ্ন। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হার মানা আঁখি এবং তার নবজাতকের দাফন হয় কুমিল্লার লাকসামে গাইনের ডহরায় বাবার কবরের পাশে। আঁখির পরিবার বলছেন, একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে পাগল প্রায় তার মা। একমাত্র সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে বিলাপ করছেন। আঁখির স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের এডি হওয়ার। কিন্তু নিমিষেই নিভে গেল সে স্বপ্ন। ভুল চিকিৎসায় একসঙ্গে নিভে গেল দু’টি জীবন।
গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে দেখা যায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। হাসপাতালজুড়ে ছিল শোকের ছায়া। শোকে পাথর হয়ে গেছেন সহপাঠী ও বন্ধুরা। ছিল স্বজনদের আহাজারি। আঁখি ও তার নবজাতকের ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তারা। আঁখির চাচাতো ভাই শাখাওয়াত হোসেন শামীম বলেন, ৯ মাস বয়সে আঁখির বাবা মারা যান। তার মা অন্যত্র বিয়ে না করে মেয়েকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে যৌথ পরিবারে বসবাস করেন। এরপর আঁখিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
ইডেনের মাস্টার্সে গণিত বিভাগে পড়াশোনা করতো সে। এ ঘটনায় আঁখির মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। সারাক্ষণ মেয়ের জন্য ছটফট করছেন। একমাত্র মেয়েই ছিল তার সম্বল। কুমিল্লার লাকসামে বাবার বাড়ি। তিতাস উপজেলার তার স্বামী শিক্ষকতা করেন। আঁখি তার সঙ্গে সেখানে থাকতো। পড়াশোনার প্রয়োজনে মাঝে মাঝে ঢাকাতে আসা-যাওয়া ছিল। গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষ হলে রাতে লাকসামের গাইনের ডহরায় পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন হয়
তিনি বলেন, আঁখির মায়ের মানসিক অবস্থা এতটাই বিপযস্ত কিছুই বলার ভাষা নেই। শুধু বলছেন, ‘আমার মেয়েকে যারা মেরে ফেললো আমি তাদের বিচার চাই। আমার মেয়ে কোথায় আমি কাকে নিয়ে বেঁচে থাকবো।’ আঁখি ও তার স্বামী তাদের অনাগত সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতো। আঁখি ব্যক্তি জীবনেও অনেক ভালো ছিল। স্বপ্ন দেখতো সে বিসিএস ক্যাডার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের এডি হবে। ভুল চিকিৎসায় আমাদের পরিবারের একটি আলোকিত জীবন নিভে গেল। ছোট শিশুটিও দেখতে পারলো না আলোর মুখ।
এমন ভুল চিকিৎসায় যেন আর কোনো সন্তান এবং মায়ের জীবন এভাবে শেষ না হয়ে যায়। কোনো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়। চিকিৎসকরা যাতে কোনো ভুল চিকিৎসা না দেন, অবহেলা না করেন। আঁখির স্বামীর অবস্থাও খুব খারাপ। মাত্র একটি নতুন জীবন শুরু করেছিলেন। ছোটবেলা থেকে আমরা কখনো তার বাবা নেই এই অভাবটা বুঝতে দেইনি। চাচারা তাকে অনেক ভালোবাসতেন। খুবই শান্ত প্রকৃতির সহজ-সরল ছিল আঁখি।
আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী বলেন, আমার তো সব শেষ হয়ে গেল। এই ক্ষতর দাগ মুছবে না। এই ক্ষতির কোনো শেষ নেই। একটা পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার শাশুড়ির এখন আর কেউ নেই। সে এখন কীভাবে থাকবে। আর আমার স্ত্রী, সন্তান ছাড়া আমিই বা কীভাবে থাকবো। আমার প্রথম সন্তানকে আলোর মুখ দেখাতে গিয়ে তাকেও ভুল চিকিৎসায় চলে যেতে হয়।
প্রথম সন্তানকে নিয়ে আমাদের দু’জনের আনন্দের শেষ ছিল না। একজন অনাগত সন্তানকে নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন থাকে। আমারদের পরিবারের দুইটা জীবনকে হত্যা করেছে চিকিৎসকরা। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই। ২০২০ সালের ২৭শে মে বিয়ে হয়েছিল আমাদের। পড়াশোনার সুবাধে মাঝে মাঝে আমার স্ত্রী ঢাকার আসতো। সে মিরপুরে থাকতো। আর বাকি সময়টা আমার সঙ্গে বাড়িতে থাকতো। আমাদের সংসারটা অল্প দিনে এভাবে ভেঙে যাবে ভাবতে পারছি না।
উল্লেখ্য, গত বুধবার সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের গাফিলতির শিকার হন আঁখি। এ সময় তিনি মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়েন। তার আগে ৯ই জুন দিবাগত রাত ১২টা ৫০ মিনিটে প্রসব ব্যথা ওঠায় আঁখিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু সেখানে ভুল চিকিৎসায় তার সন্তানের মৃত্যু হয়। রোববার দুপুরে ল্যাবএইড হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
এদিকে এ ঘটনায় বুধবার ধানমণ্ডি থানায় অবহেলাজনিত মৃত্যু’র একটি মামলা দায়ের করেন আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী। মামলায় ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা, ডা. মুনা সাহা, ডা. মিলি, সহকারী জমির, এহসান ও হাসপাতালের ম্যানেজার পারভেজকে আসামি করা হয়। এ ছাড়াও অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। মামলা দায়েরের পর ১৫ই জুন রাতে ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনা সাহাকে হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২০ জুন ২০২৩, সকাল ১০:১০
Discussion about this post