নিজস্ব প্রতিবেদক
ছাত্রনেতা থাকা অবস্থায় কাছে থেকে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খানকে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকার সময়ে সিরাজুল আলম খানের সংসর্গে আসেন। তারপর থেকেই বুঝতে শুরু করেন সিরাজুল আলম খান নেপথ্যে থেকে রাজনীতির নেয়ামকের ভূমিকা রাখছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম অনুষঙ্গ নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের আরেক সংগঠক ও ছাত্রলীগের এক সময়ের সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি জানিয়েছেন নানা অজানা তথ্য।
তিনি বলেন, সিরাজুল আলম খান ছিলেন কিংবদন্তি সংগঠক। নির্মোহ, নিরহংকার, নির্লোভ ও দৃঢ়চেতা একজন মানুষ। তিনি আন্দোলন সৃষ্টি করার এক নিপুণ কারিগর। ছাত্রলীগের সদস্য হওয়ার পরে সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় জানতে পারি ছাত্রলীগের পেছনে একজন নায়ক আছেন। তার নাম সিরাজুল আলম খান।
অত্যন্ত মেধাবী। ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় একদিন ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। তিনি বললেন, আমি তোমার সম্পর্কে সব জানি। পরদিন ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) পুকুর পাড়ে এক ঘণ্টা আড্ডা দিলাম। এটা ওনার সঙ্গে আমার প্রথম আলোচনা। বলতে পারি মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন একজন, ছাত্রলীগেও সিরাজুল আলম খান একজন।
মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, ছাত্রলীগকে সংগঠন হিসেবে শক্তিশালী করার পেছনে সিরাজুল আলম খানসহ কয়েকজনের ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৬৯-এর আন্দোলনের সময় সরাসরি সিরাজ ভাইয়ের হুকুম পাওয়া পর্যায়ে আমি উন্নতি হই। বুঝলাম আন্দোলনের মূল কারিগর তিনি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় তোফায়েল ভাইয়ের বক্তৃতা কী হবে তা তিনি ঠিক করে দিতেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা হওয়ার আগ থেকে অনুধাবন করি ১৯৬২ সাল থেকে স্বাধীনতা নিউক্লিয়াস নামে একটা ফরমেশন কাজ করতেছে। কিন্তু কেউ নিউক্লিয়াস সম্পর্কে কিছু বলেনি। আমিও অতিউৎসাহী ছিলাম না। এটা সত্য ৬ দফার মধ্যে আমি স্বাধীনতার গন্ধ পেয়েছি। আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের পেছনে সিরাজ ভাইয়ের কারিগরি ভূমিকা প্রথম আমার নজরে আসে। আর ’৬৯ এর আন্দোলনের পর সিরাজ ভাইয়ের ব্যক্তিত্ব ও ইমেজ ছাত্রদের মধ্যে অনেক উপরে উঠে গেছে। ওই সময় শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক এ চারজনই একটা নিউক্লিয়াস ছিল ছাত্রলীগের ব্যাপারে। ভেতরে কিছু থাকলেও আমরা সচক্ষে তাদের মধ্যে কোনো বিতর্ক দেখি নাই।
সিরাজ ভাই শুনতেন বেশি, বলতেন কম। বক্তব্যে কারও প্রতি বিদ্বেষ ছিল না। কারও বক্তব্যে একমত না হলে বলতেন আমি চিন্তা করে দেখি। ওনার বক্তব্যে কেউ দ্বিমত করলে কারও পক্ষে বা বিপক্ষে বলতেন না। তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন।
সিরাজ ভাইকে আমরা বিভিন্ন গ্রুপে ব্যবহার করতে চেয়েছি। একইভাবে বঙ্গবন্ধুকে জড়াতে চেয়েছি। মনি ভাইকে জড়াতে চেয়েছি। এটা আমাদের ব্যাপার। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটা এক সময় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে রূপ লাভ করে। আমি আজও মনে করি ’৬৯-এ আইয়ুব খানের পতনের পর থেকে স্বাধীনতার পরে পর্যন্ত ছাত্রলীগে ভিন্নমত দুইটা ধারায় রূপ নেয়। আগে আমরা এটা তীব্রভাবে অনুভব করিনি। এটা নিয়ে সুচিন্তিত মহল কখনো গভীরভাবে ভাবেনি।
’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় আমরা রাজপথে স্লোগান দিচ্ছি- ‘শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া, গোল টেবিলে যাবে কারা’; ‘গোল টেবিল না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ।’ এই যে স্লোগান তার পেছনে সিরাজুল আলম খান। এটা আমাদের কাছে সরাসরি আসতো না। যখন যাকে পেতো তার মাধ্যমে তিনি পাঠিয়ে দিতেন। এরপর আমরা সবার কাছে পৌঁছে দিতাম। একটা সময় ছাত্রলীগ যে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, আন্দোলন যে তীব্র হচ্ছে- এর পেছনের কারিগর ছিলেন সিরাজ ভাই। তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে এসব পরিচালনা করতেন।
এমন কি তোফায়েল ভাই যে ২৩শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন আমার ধারণা এটাও সিরাজ ভাই বলে দিয়েছেন। তবে তোফায়েল ভাইকে কখনো এটি জিজ্ঞেস করিনি যে, এ বিষয়টি কোথায় পেলেন তিনি। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে যেতে চাইলে অনেকে বিরোধিতা করে। সিরাজ ভাই কোনোদিন প্রকাশ্যে ৭০-এর নির্বাচনে যাওয়ার বিরোধিতা করেননি। নির্বাচনের তফসিল হওয়ার পর তিনি সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। এ নির্বাচনে জেতার পেছনে যে ক’জন লোক ভূমিকা রেখেছেন সিরাজ ভাই তাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু অনেকে এটা টের পাননি।
নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় আমরা সিরাজ ভাইকে অভ্যন্তরীণ গ্রুপে ব্যবহার করেছি। একদিন আমি ওনাকে কিছু রাজনৈতিক প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছিলাম- সিরাজ ভাই আমরা কি এক থাকতে পারবো। তিনি বলেছেন- বঙ্গবন্ধু যতদিন আছে ততদিন অসুবিধা হবে না। ব্যবধান না বাড়ানো উচিত, এটা বাড়ালে এর কোনো শেষ নেই। আমাদের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকলেও সংগঠন ভাঙার প্রতি কারও ইচ্ছা ছিল না।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি সিরাজ ভাইয়ের আনুগত্য অনেক বেশি, আর বঙ্গবন্ধুও উনাকে অনেক আদর করতেন। এককভাবে যদি কেউ নেতাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বেশি আদর পেয়ে থাকেন আমি মনে করি সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না।
যুদ্ধের পর ছাত্রলীগে বহিষ্কার- পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনার পর ছাত্রলীগ নিয়ে সিরাজ ভাই’র সঙ্গে আমার আর কোনো কথা হয়নি। তখন ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি সিরাজ ভাই থেকে মনি ভাইয়ের কাছে চলে যায়।
জাসদ সৃষ্টির পর সিরাজ ভাই একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু আমাকে সিরাজ ভাইকে দেখতে যেতে বলেন। এসময় তিনি আমাকে একটা প্যাকেট দিলেন। এতে ৫০ হাজার টাকা। বললেন, এটা সিরাজকে দিও। আমি টাকাটা নিলাম না। আমি বললাম আমি সিরাজ ভাইকে বলবো আপনি খোঁজ নিয়েছেন। উনি যেন যোগাযোগ করেন। আমি সিরাজ ভাইকে দেখতে গেলাম। জিজ্ঞাস করলাম ওষুধ খেয়েছেন কিনা? তিনি বললেন, ওষুধ খাওয়া লাগবে না। এমনিতে ঠিক হয়ে যাবে। বললাম, আপনার জ্বরের খবর পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর কাছে। তিনি নাড়াচড়া দিয়ে উঠলেন…।
বললেন, আমি যে ওষুধ খাইনি এটা বঙ্গবন্ধুকে বলবে না। তখন দেখি সিরাজ ভাইয়ের চোখে পানি। একজন রাজনৈতিক কর্মীকে এত ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তারপরও রাজনীতি এমন জিনিস দুই মেরূকরণ হয়েছে এটাই তো সত্য।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় প্রায় তিন বছর পর সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে একদিন দেখা করতে গেলে তিনি আমাকে বললেন কী করছো, খবর কী। আমি বললাম আমি আর রাজনীতি করবো না। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের এ পরিণতি, আপনাদের রাজনীতির এ বিপথগামিতা! উনি বললেন- আমাকে টানছো কেন? বললাম সবাইতো বলে এটা আপনার দল। এই যে কাল্পনিক রাজনীতি, এ পরিণতি দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আর রাজনীতি করবো না। সরাসরি বললাম- আমাদের মধ্যে ভাঙন আমাদের জাতীয় বিপর্যয়। এর পেছনে কেউ কেউ আছে। আমি জানি না কে দায়ী। তিনি বললেন- করলা কেন? আমি বললাম করছি এ জন্য যে মুক্তিযুদ্ধের যে প্রোডাক্ট, ’৬৯-এর আন্দোলনের যে প্রোডাক্ট, যে মেধাবীরা ছাত্র রাজনীতিতে এসেছে তার ৫০ ভাগের অধিক ইতিমধ্যে আপনার সঙ্গে চলে গেছে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বলে। এরা সরকারের সঙ্গে থাকা মানে মনে করে অপরাধ। এরা মনে করে ৯ মাসে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেছে, ৬ মাসে সমাজতন্ত্র হয়ে যাবে। এ কাল্পনিক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিজের বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারলাম না।
বললাম, কোনো কারণে যদি আমি তিন দিন ক্ষমতা পাই তিনটা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবো। প্রথম দিন জাসদ যারা গঠন করেছে তাদের চিহ্নিত করে ফাঁসিতে দেব; মিজান আওয়ামী লীগ গঠনকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করবো। এরপর নিজেকে নিজে শেষ করে দেবো। তিনি বললেন- ওহ তাই! সিরাজ ভাই’র সঙ্গে এরপর একবারও আমার বিরোধ হয়নি। এরপর অন্তত ১০ বার ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। এরপর বহুদিন পরে একদিন দেখা হয় কিন্তু তিনি পুরনো কথা তুললেন না।
একটা কথা বলি, জাসদ যখন বাড়াবাড়ি করছে একদিন বিরক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম। বললাম ওরা যা করছে তা মোকাবিলা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তিনি বললেন যে, তুমি মোকাবিলা করো। আমি তোমাকে মোকাবিলা করতে বলি নাই। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম কেন? তিনি বললেন, আমারও তো পর আছে। তুমি কি চাও আমার পরে মুসলিম লীগ আবার ক্ষমতায় যাক? জাসদ এদিকে কার্যকর বিরোধী দল হবে। তাদেরকে বেঁচে থাকতে দিতে হবে। এভাবে সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ ছিল। জাসদের অরাজকতা বন্ধ করতে সিরাজ ভাই বলতেন কিনা আমি জানি না। এমনকি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে তিনি কোনোদিন বলেছিলেন কিনা আমি জানি না। এ জন্য হয়তো ওনাকে রহস্য পুরুষ বলে।
তিনি বলেন, আমি দূর থেকে যেটা দেখেছি সেটা হচ্ছে সিরাজ ভাই অপব্যবহার হয়েছে। কেউ বলে তাদেরকে সিরাজ ভাই বিপথগামী করেছে। আমি মনে করি তারা সিরাজ ভাইকে বিপথগামী করেছে। সিরাজ ভাই’র সঙ্গে যতটুকু ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল সবটাই তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। বঙ্গবন্ধু কখনো সিরাজ ভাই’র বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেননি। সিরাজ ভাই কখনো বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একটা কথা বলেননি।
মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে আজন্ম মেধাবী শ্রেণি রাজনীতিতে যোগদান করলেন, হাজারো মায়ের সন্তান- জাসদ সৃষ্টির পর এরা জাতির কোনো কাজে লাগেনি। এমনকি তাদের পরিবারেরও কোনো কাজে লাগেনি। হাজারও মেধাবী বিপথগামী হয়েছে। তারপরও একটা শ্রেণি রক্ষা হয়েছে আমরা না চাইলে সেটাও হতো না। ’৭৩ সালে ছাত্রলীগ ভাগ না হলে এই শ্রেণি থাকতোই না। এটা আমার পর্যবেক্ষণ। এক বছর পর শূন্য হয়ে যেতো। সিরাজ ভাই যেমন ওদের ওপর অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করেছে যা চায় নি তা করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুও হয়তো যা বিশ্বাস করতেন না তা করতে হতো। সেটা ভালো হতো কিনা আমি জানি না।
যে পর্যন্ত সিরাজুল আলম খান যুদ্ধ করেছে তাতে বাংলাদেশের সবার সম্মান দেখানো উচিত। আজকে আওয়ামী লীগের কেউ যদি সিরাজ ভাই সম্পর্কে খারাপ কিছু বলেন, সেটা সিরাজ ভাইয়ের প্রতি সুবিচার করা হবে না। বঙ্গবন্ধু এরকম কথা বলে যাননি। উনি জাতির কাছে সম্মান চাননি আর আমরাও দিতে জানি না। এ জাতি কাউকে কিছু দেয়নি, আমার মনে হয় আমরা নগদ নারায়ণ জাতি। যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছে তাদের আমরা ক’দিন মনে করি?
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন ২০২৩, রাত ১২:১৪
Discussion about this post